বৃহস্পতিবার, ৪ জুন, ২০১৫


আমার বাড়িতে একটা হাতি ছিল। আসল নয়,খেলনা হাতি। আমার মাসি কিনে দিয়েছিল আমাকে। আমি তো তখন ছোট ছিলাম। হাতিটার রং ছিল গোলাপী,আমি সারাক্ষণ হাতিটাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। হাতিটাকে খাইয়ে দিতাম,চান করিয়ে দিতাম। মা যখন আমার মুখে খাবার তুলে দিত,হাতিটা আমাকে দেখে হাসত।হাতিটার আমি একটা নামও দিয়েছিলাম।হাজুগুজু। হাজুগুজু কে আমি রোজ বিকেলে সাজুগুজু করে আমার বইপত্রের ওপর রেখে দিতাম।যখন পড়তে গিয়ে আমার ঘুম পেত,হাই উঠত,হাজুগুজুর দিকে চোখ চলে যেত। দেখতাম,সে শুঁড় তুলে হাসছে মুচকি মুচকি।আমি তখন তার কান মলে দিতাম।হাজুগুজুর পায়ের তলায় একটা বোতাম ছিল। ওতে ফু দিলে সিটি বাজত। হাজুগুজু যখন দুষ্টুমি করত,আমি ওই সিটিটা বাজিয়ে দিতাম। আমার মনে হত,ঐখানে ফু দিলে হাতিদের কাতুকুতু লাগে।হাতির কাতুকুতু।কি মজা।হাজুগুজু আমার সাথে থাকত সারাদিন।আমি যখন স্কুলে যেতাম মা ওকে শোকেসে রেখে দিত।একদিন আমি হঠাৎ বড় হয়ে গেলাম। সবার অলক্ষ্যে আমার হাজুগুজু,আমার সারাক্ষণের খেলার সঙ্গী ছোট্ট গোলাপী হাতিটা কোথায় হারিয়ে গেল।
আমার বাড়িতে একটা ছাদ ছিল। খুব বড় ছড়ানো ছাদ।মাঝখানে ছিল একটা জালতি।সেখান থেকে একতলায় দেখতে পাওয়া যেত। আমি দুপুরবেলায় ছাদে গিয়ে পেয়ারা খেতে খেতে জালতি দিয়ে নিচে তাকিয়ে থাকতাম।আমার মা নীচের কলতলায় বাসন মাজত,জেঠিমনিরা তোষক রোদে দিত। মাঝে মাঝে পোস্টম্যান এসে চিঠি দিয়ে যেত। সব দেখতে পাওয়া যেত জালতির ওপর থেকে। বিকেল বেলায় আমি প্লাস্টিকের বল আর ব্যাট নিয়ে দাদার সঙ্গে খেলতাম ছাদের ওপরে। দাদা আমার চেয়ে অনেক বড় ছিল। প্রায় ৬ বছরের বড়,কিন্তু সে আমার সঙ্গে খেলতে ভালবাসত।একটু এদিকদিক হলেই জালতি দিয়ে গলে বলটা নিচে চলে যেত,তখন আমাদের তিনতলা সিঁড়ি ভেঙ্গে নামতে হত।দাদা আমাকে বার বার যেতে দিত না,নিজেই বল নিয়ে আসত। অন্যদের ছাদে বল চলে গেলেও সে গিয়ে উদ্ধার করত বল। আমি মাঝে মাঝেই ছয় চার মারতাম আর আনন্দে নাচানাচি করতাম। পরে বুঝেছি ,আমাকে দাদা ইচ্ছে করেই লোপ্পা বল দিত। আমাকে সামলে রাখত,ঘুরতে নিয়ে যেত রথের মেলায়,আমাকে সঙ্গে করে ঝুলনে জন্মাষ্টমী সাজাত। বাজি পোড়াত।আমার বুড়োদাদা (যাকে বুড়ো বললে রেগে যেত),তাই আমি বলতাম বুরাদা। একদিন বুরাদা খুব বড় হয়ে গেল,পড়ার চাপে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ভীষণ।আমিও ভুলে গেলাম ওকে। আস্তে আস্তে আমার অজান্তে আমার পুরনো বাড়ির ছোটবেলার ছাত,জালতি,ব্যাট বল,জন্মাষ্টমী সাজানো ,বাজি পোড়ানো সব হারিয়ে গেল। চিরকালের মত।
আমার কয়েকটা বন্ধু ছিল আমরা একসঙ্গে ঘুরতাম,একসঙ্গে দুষ্টুমি করতাম,একসঙ্গে স্কুল যেতামভাবতাম আর যাই হোক,আমরা একসঙ্গেই থাকব তারাও হারিয়ে গেলহারিয়ে গেল একে একে আমার আঁকার খাতা,আমার ক্যাসেটের তোরঙ্গ ,আমার কমিকসের বাক্স,স্কুল,গলি,খেলা ঠাকুমা,ভাইবোন,মাসিপিসি,পুজোর উল্লাস,ছুটির উৎসাহ ছোট বেলাটাই হারিয়ে গেল কেটে যেতে লাগলো বছরের পর বছর এই নাকি বড় হওয়া সকলে হারিয়ে যাবে,চলে যাবে একে একে,কিন্তু তোমার আর তাদের জন্য মন কেমন করবে না অনেক রাগ জমেছে যে,সবার ওপর,কেন এত বাঁধন?জীবনের বন্দীদশার রাগে স্মৃতির মূল্য কমে গেছে

অনেকদিন পর বাড়ি গেলামবন্ধুদের সঙ্গে দেখা করাটাই আসল তাও খানিকটা সময় থাকি বাবা মায়ের সাথেবেশিক্ষণ ঘরে থাকতে ইচ্ছে করে নাকাগজ নড়াচড়া করতে গিয়ে দেখি,সেখানে উল্টে পড়ে আছে আমার হাজুগুজু কি ময়লা হয়ে গেছে কত বছর ধরে পড়ে আছে কে জানে,মার কাছে নিয়ে গেলাম ওকে বললাম,এটা খুঁজে পেলাম,আমার পুরনো খেলার সঙ্গী ,হারিয়ে গিয়েছিলমা একটুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আমার দিকে তারপর বলল,' হারিয়ে গেছিল না  তুই হারিয়ে  গেছিলি?'

পঁচিশ বছরের স্মৃতি এক লহমায় ঘুরে গেল আমার চোখের সামনে দিয়ে হাজুগুজু,বুরাদা,তিনতলার ছাদ,ক্রিকেট,ছোটবেলার বন্ধু,গল্প,আড্ডা,সাইকেল,স্কুল,পুজো,গরমের ছুটি,আমার ছোটবেলাআমার কৈশোরবুঝতে পারলাম,কেউই হারিয়ে যায়নি,আমাকে ছাড়া আমিই আমাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম হারিয়ে ফেলেছি আমাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না