বইপত্র

সোমবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৫

বাংলার স্টেশন কথা

 


একটা বই কী করে হয়?

একটা বই করে কী হয়?

দুটো প্রশ্নের উত্তরই কেস স্পেসিফিক। একটা বই করে আসলে কিছুই হয় না হয়তো; শুধু শুধু মানসিক চাপ নেওয়া, ঘাড়ে পিঠে ব্যাথা হওয়া, কিংবা চোখের বারোটা বাজানো। আবার হয়তো, একটা বই করে একজন ভীষণ আনন্দ পায়। গোটা প্রসেসটার সময় তো বটেই, তার পরেও সেই বইটা তাঁর জীবনে ভ্যালু অ্যাড করে। ওদিকে, একটা বই তৈরি হওয়াও নানারকম। আমার স্বল্প অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এই রবিবার পান্ডুলিপি শুরু হয়ে পরের শনিবার জমা হলে আসছে সোমবার বই ছাপাইতে চলে যায়। আজকাল অ্যাসেম্বলি লাইনে ফেলে বই করা কোনও ব্যাপারই নয়। ওদিকে এমনও ঘটে, যে ভীষণ নাকমুখ কুঁচকে একটা বই নিয়ে বছর কাবার করে দেন লেখক/প্রকাশক, নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ান, অথচ বই হাতে নেওয়ার পর সেই যত্ন চোখে বা মনে ধরা পড়ে না।

কথাগুলো মনে পড়ল, এই বইটার কথা উঠতে। ট্রেন নিয়ে আমার বাড়াবাড়ি রকমের আগ্রহ আছে বটে, কিন্তু বাংলার স্টেশন নিয়ে আমি ওই দু একটা বই পড়ে ভাসাভাসা যা জানা যায়, তার চেয়ে বেশি কিছু জানি না। তবু কেন জানি সম্পাদক জুটি আমাকে প্ল্যানিং টিমে রেখেছিলেন কে জানে? হয়তো ট্রেনের প্রতি আগ্রহের কথা জেনে গিয়েছিলেন বলেই! ফালতু বকা ছাড়া আমার কন্ট্রিবিউশান শুন্য। মাইনাসও বলা যায়। কিন্তু এই গোটা সময় ধরে আমি দেখলাম, একটা 'নট সো কমন' বিষয়বস্তুর বইটাকে একটা 'নট সো কমন' বই বানানোর জন্য দুজন মানুষ কী খাটুনিই না খাটলেন!

ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সালে যখন আমাকে গ্রুপে ঢোকানো হয়, তার সম্ভবত বছর খানেক আগে থেকেই বইয়ের খসড়া করা শুরু হয়ে গিয়েছিল। মানে, বিষয়বস্তু সম্পর্কে হোমওয়ার্ক করা, অন্যান্য বই গুলে খাওয়া, কে বা কারা লিখতে পারেন, কী নিয়ে লিখতে পারেন, তার একটা প্রাথমিক পরিকল্পনা আগেই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ম্যানুস্ক্রিপ্টের যেমন ড্রাফট ১ থেকে ২০ হতে পারে, প্রাথমিক পরিকল্পনাও ফাইনাল হতে গিয়ে পঞ্চাশবার অদলবদল হয়।

একপর্ণিকা ছোট প্রকাশনী। ত্রিপুরা থেকে বই করে, প্রকাশক কলকাতায় আসেন না। মানে, আসেনই না। মুখ দেখাতেও না। জয়ঢাক প্রকাশন তাদের পরিবেশক, বই তাই সহজলভ্য। কিন্তু মূল প্রকাশকের বই করে কতটা প্রফিট হয়, কতজন পড়েন আমার জানা নেই। আন্দাজ করছি, সঙ্খ্যাটা মারাত্মক কিছু নয়! তবু, একটা বই নিয়ে এই লং টার্ম এফর্ট দেওয়া, এই আন্তরিক যত্ন আর নিজের দিক থেকে পরিশ্রমের ত্রুটি না রাখার প্রসেসটা আমি বেশ কয়েক বছর ধরে লক্ষ করছি।

তা সত্ত্বেও কি সব সময় বই একদম পারফেক্ট হয়? সব বইই কি বিষয়বস্তু, প্রোডাকশন বা প্রচ্ছদের দিক থেকে আমার চোখে দারুণ কিছু বলে মনে হয়?

না। হয় না।

এটাই সত্যি কথা। বানানের ভুল থাকতে পারে, প্রচ্ছদ আমার পছন্দ না হতে পারে, মেকিং বা প্রুফের ত্রুটিও কিছু থাকতে পারে মাঝেমধ্যে। থাকেও।

কিন্তু যে জিনিসটা আমাকে মুগ্ধ করে, তা হল একজন মানুষের প্রতিবার নাছোড়বান্দা পারফেকশন পাওয়ার জন্য করা এই চেষ্টাটা। প্রকাশনী বলতে তো একজন মাত্র মানুষ। বাজেটও নেই। লোকবলও নেই। শুধু ভালো বই করার জেদ আছে, ইচ্ছে আছে। আমি জানি, এমন প্রকাশনী আরো আছেন। অনেকেই আছেন, শূন্য লাভ নিয়েই লড়ে যাচ্ছেন। একবার একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমার বাংলা প্রকাশনা জগতে কী ভালো লাগে? আমি বলেছিলাম, হাজার অপেশাদারিত্ব আর বিতিকিচ্ছিরি রকম পলিটিক্স আর স্ট্রাকচারহীন জগতে থেকেও কয়েকজন মানুষ সব প্রফিট লসের হিসেব ভুলে ভালো বই করার জন্য খাটছে, বুদ্ধিসুদ্ধি শিকেয় তুলে প্যাশন নিয়ে বাঁচছে। ওইটুকুই ভালো লাগা। ওইটুকুই।

এইবার আমি একটা বই বানাতে দেখলাম, যেটার সঙ্গে আমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবেও হয়তো জড়িয়েও নেই। না আমার লেখা আছে, না আমি সম্পাদক, না বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা আছে। সেইজন্যই বুঝি আরো মন দিয়ে দেখতে পেলাম, অনুভব করতে পারলাম, এই বইটা ঠিক কতটা যত্ন নিয়ে তৈরি করা হল?

বাংলায় স্থানীয় স্টেশন নিয়ে একাধিক কাজকর্ম হয়েছে। কিন্তু সাবজেক্টটা এতটাই বড় যে প্রতিটা অঞ্চলের স্টেশন নিয়ে এক একটা সিরিজই হয়ে যেতে পারে। আচ্ছা, তুলনামূলক ভাবে অজানা বিষয় নিয়ে লেখা সংগ্রহ করার জন্য সম্পাদকরা কী কী করেছেন? বইটাকে ভালো করার জন্যই বা তাঁরা কী করেছেন? আমি বরং কয়েকটা পয়েন্ট লিখে দিই।

১) আই আর এফ সি এ অর্থাৎ ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাব ফোরামের যাবতীয় লেখালিখি পড়ে দেখেছেন, দরকারে সেই লেখা নিয়ে অন্যান্য বইপত্র/লেখালিখি ঘেঁটে দেখেছেন। এই আমি বললাম হয়তো পার্থপ্রতিম বাবু ট্রৈনিকে রেল নিয়ে চমৎকার কাজ করছেন না ভারতীয় রেল হেরিটেজ নিয়ে দীপক রায়চৌধুরী বহুদিন ব্লগ লিখেছেন, রাজীববাবু ছুটলেন খবর নিতে। হয়তো বললাম আমার বন্ধু কাম দাদা Saugata Sengupta পুরো রেলপাগলা লোক, রাজীবদা ঝাঁপ মারলেন। আমি বলেই খালাস। যেখানে দেখো ছাই উড়াইয়া দেখো তাই, সম্পাদক-জোড় কিছুই করতে বাকি রাখেননি।

২) বইয়ের স্ট্রাকচার নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলেছে। কী নিয়ে লেখা থাকবে আর কী নিয়ে থাকবে না, কোন বিষয়টা নিয়ে বইটা গড়ে উঠলে পাঠকটা নতুন কিছু পাবেন না পূর্ববর্তী বইগুলোর কোন লেখাগুলো নিয়ে কচলানোর দরকার নেই, সেই নিয়ে এমন গভীর, উত্তপ্ত, যুক্তিগ্রাহ্য আর দীর্ঘ আলোচনা চলেছে যে আমি মাঝেমধ্যে খেই হারিয়ে ফেলেছি।

৩) বইতে কন্ট্রিবিউটার হিসেবে অংশগ্রহণ করার জন্য কাকে কাকে অনুরোধ করা হবে, সেই নিয়েও প্রচুর মেল/মেসেজ চালাচালি হতে দেখেছি, ফোনও হয়েছে। বিষয়বস্তু নিয়ে অগাধ জ্ঞান কিন্তু লেখা তুলনায় শুষ্ক, আবার লেখার শৈলী অনবদ্য কিন্তু বিষয়বস্তুর নিরিখে সেই লেখা বিশেষ কোনও ভ্যালু অ্যাডিশন করছে না... এক্ষেত্রে কী করা যায়? এই ব্যাপারটা শুনতে যত সহজ মনে হয়, সিদ্ধান্ত নেওয়া ততোটাই কঠিন। বাংলা লেখালিখির জগতে কোনও কাজের মূল্য নির্ধারণ করা নেই, সবসময় ভালো লেখা পাওয়াও যায় না। আমি খুশি, অবশেষে একটা চমৎকার ব্যালেন্স করে নেওয়া যায় ভালো সম্পাদক পাওয়া গেলে। এখানেও দিব্যি কাজ হয়েছে।

৪) সম্পাদনার ক্ষেত্রে এমন সমস্ত ছোটখাটো সমস্যা দেখা যায়, সাধারণত যে সব নিয়ে কেউ মাথাই ঘামায়নি। এই ধরুন, একটা স্টেশনের নাম। বাংলায় একরকম, স্থানীয় ভাষায় একরকম, হিন্দিতে একরকম। কোনটা রাখা হবে? আপনি হয়তো ভাবছেন বাংলা বইয়ে বাংলা নাম, সিম্পল! কিন্তু ব্যাপারটা অমন নয়। একটা নামের ইতিহাস বা কালচারাল সিগ্নিফিকেন্স এক একটা লেখার এমন ভাবে ঢুকে থাকে, তখন সেটাকে বদলে দেওয়া মোটেও সহজ হয় না। সেই নামের ব্যাঞ্জনার সঙ্গে লেখা ও বিষয়ের যে সামঞ্জস্য আছে, সেটা ব্রেক করলে সব ঘেঁটে ঘ হয়ে যাবে। এমন হাজারও জিনিস, স্ট্রাকচারিং থেকে প্লেসমেন্ট, সূচিপত্রের অদলবদল, ভূমিকা ও ব্লার্ব, এক একটা শব্দের ভূমিকা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমি দীর্ঘ আলোচনা হতে দেখেছি। এক একটা সময় এমন হয়েছে, কাজ পনেরো আনা শেষ হয়ে আবার শুরু করতে হয়েছে, কারণ সামান্য একটা ভুল 'হয়তো' হলেও হতে পারে। এই অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্য না সম্পাদক না প্রকাশক একবারের জন্যও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।

৫) বইয়ের সঙ্গে যে জরুরি ছবি, নথি, অলংকরণ ইত্যাদি যাবে, সেই নিয়েও তুমুল আলোচনা আর মাঝেমধ্যে মতান্তর হয়েছে। কিন্তু অবশেষে দেখা গেছে, বইয়ের জন্য যা জরুরি, সেটাকেই প্রায়োরিটি দেওয়া হয়েছে। কেউই ইগোবশত নিজের মতামত জোর করে চাপিয়ে দেয়নি। পাশাপাশি আবার 'বই কে ওয়াস্তে সব মঞ্জুর' বলে কপিরাইটেড ছবি বা অন্য বইয়ের/শিল্পীর অলংকরণ/ফোটোগ্রাফ কিছুই ব্যবহার করেননি। এই বিশেষ কাজটা করার জন্য আমি ব্যক্তিগত ভাবে টুপি খুললাম।

৬) প্রচ্ছদ যে ঠিক কতবার বানানো হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। একইভাবে কাজ হয়েছে ভিতরের ছবি নিয়েও। ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ক্যালিগ্রাফি, স্টাইল থেকে রঙের ব্যবহার, দিনের পর দিন ধরে কাজ চলছে তো চলছেই। বইমেলা চলে এল, বই হল না। নববর্ষ দোরগোড়ায়, তবু দুজনে ঘাড় গুঁজে কাজ করছে। ইভেন্ট চলে গেলে বই আদৌ বিকোবে কিনা, সে নিয়ে কারো হেলদোল নেই। দুজনের সিদ্ধান্ত, বই পারফেক্ট না হলে তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই। মিথ্যে বলব না, মাঝেমধ্যে দু এক মুহুর্তের জন্য তো আমিই ভেবেছি, ওরে বাবা! এত বাড়াবাড়ি করে কী লাভ? কতজন আর পড়বে? তারপর দুই সম্পাদকের হাড়ভাঙা খাটুনি দেখে নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছে হয়েছে। অবশেষে সব বাধা বিপত্তি কাটিয়ে কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

সেই বইয়ের প্রচ্ছদ প্রকাশ হল কাল। আন্তরিক যত্ন আর পরিশ্রমে করা একখান বই। হয়তো পারফেক্ট, হয়তো পারফেক্ট (পার্ফেক্ট বলে কিছু হয়ও না) নয়, কিন্তু পারফেক্ট করার ইনটেনশনটা, ইচ্ছেটা, পরিশ্রমটা ...সেটা অবশ্যই পারফেক্ট।

আমি বইটার সঙ্গে কোনওভাবেই যুক্ত নই। তবু মেকিং সম্পর্কে দু একটা কথা বললাম, সাধারণত 'বিহাইন্ড দ্য বুক' নিয়ে কথা হয়, অথচ সিনেমায় 'বিহাইন্ড দ্য সিনস' নিয়ে এক একটা ডকুমেন্টারি হয়ে যাচ্ছে। যাই হোক, ট্রেন নিয়ে আগ্রহী পাঠকদের কাছে অনুরোধ, বইটা উল্টেপাল্টে দেখবেন। দেখে জানাবেন, যত্নটুকু চোখে আর মনে ধরা পড়ছে কিনা! যদি পড়ে, সম্পাদক জুটির সব কষ্ট সার্থক।

বাংলার স্টেশন কথা
একপর্ণিকা প্রকাশনী
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন